শ্বাসের শক্তি: কীভাবে এটি আমাদের কোষকে জ্বালানি জোগায়
ভূমিকা
প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে আমরা শ্বাস নিচ্ছি ও ফেলছি। কখনও কি ভেবেছেন, এই সাধারণ শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে কী অসাধারণ ঘটনা ঘটে চলেছে? আমাদের নেওয়া প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন নামে এক অদৃশ্য মিত্র শরীরে প্রবেশ করে – যা ছাড়া প্রতিটি কোষ শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আসলে শ্বাস শুধুই গ্যাসের আদান-প্রদান নয়; এটি জীবনধারার মূল ছন্দ। প্রাচীন যোগশাস্ত্রে বলা হয় প্রাণ – অর্থাৎ জীবনশক্তি – এই শ্বাসের সঙ্গেই আমাদের দেহে প্রবাহিত হয়। তাই শ্বাসকে আমরা শুধু বায়ু নয়, জীবনীশক্তির বাহক বলেও দেখি। বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই শ্বাস-প্রশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম, এবং দু’দিকের ভাবনা মিলিয়ে এটি আমাদের দেহ ও মনকে সজীব রাখে।
মোমবাতির শিখা এবং কোষের অভ্যন্তরীণ আগুন
একটি জ্বলন্ত মোমবাতির শিখার কথা কল্পনা করুন। শিখাটি টিমটিম করে জ্বলছে, কারণ তার কাছে পর্যাপ্ত মোম (জ্বালানি) আর বাতাসের অক্সিজেন আছে। যদি আপনি মোমবাতির ওপর ঢাকনা দিয়ে বাতাস বন্ধ করে দেন, শিখা নিবে যায় – কেননা অক্সিজেন ছাড়া আগুন টিকে থাকতে পারে না। ঠিক একইভাবে, আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে একটি ছোট্ট "অভ্যন্তরীণ আগুন" জ্বলছে, যা আমরা খাবার থেকে পাওয়া জ্বালানি ধীরে ধীরে "পোড়াচ্ছি"। এই পোড়ানো বলতে আসলে এক ধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়া, যাকে সেলুলার রেস্পিরেশন বলা হয় – যেখানে কোষ অক্সিজেন ব্যবহার করে খাদ্য (যেমন গ্লুকোজ) ভাঙছে এবং শক্তি মুক্ত করছে। এটি কোনো দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন নয়, বরং মোমবাতির শিখার মতোই একটি ধীর, নিয়ন্ত্রিত জ্বলার প্রক্রিয়া, যাতে শক্তি আস্তে আস্তে নির্গত হয় এবং আমাদের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রতিটি শ্বাস যখন আমরা নেই, অক্সিজেন আমাদের রক্তের মাধ্যমে সেই কোষগুলিতে পৌঁছে যায় এবং তাদের শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে। ফলাফল হিসেবে কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানি তৈরি হয় – যা মোমবাতির শিখার ধোঁয়ার মতোই বর্জ্য – এবং আমরা প্রশ্বাসের মাধ্যমে সেই বর্জ্য বাইরে বের করে দেই। আপনি গভীর শ্বাস নিলে বেশি অক্সিজেন পান, তখন এই ছোট্ট জ্যোতিগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে, শরীর বেশি শক্তি পায় এবং মনও সতেজ বোধ করে।
দেহযন্ত্রের ইঞ্জিন হিসেবে শ্বাস
এবার একটা গাড়ির ইঞ্জিনের কথা ভাবুন। গাড়ি চলতে পেট্রোল বা ডিজেলের মতো জ্বালানি লাগে, তবে শুধু জ্বালানি দিলেই হয় না – ইঞ্জিন চালু করতে অক্সিজেনও দরকার, যা বাতাস থেকে আসে। ইঞ্জিনে জ্বালানি ও বাতাস মিশে বিস্ফোরণ ঘটায়, তাতে শক্তি উৎপন্ন হয় এবং গাড়ি চলে; আর এক্সহস্ট পাইপ দিয়ে ধোঁয়া বা বর্জ্য বের হয়। আমাদের শরীরটাও অনেকটা সেই গাড়ির মতো। আমরা যে খাবার খাই তা হলো জ্বালানি, আর শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে পাওয়া অক্সিজেন সেই জ্বালানিকে পুড়িয়ে শক্তিতে রূপান্তর করতে সাহায্য করে। প্রতিটি কোষ যেন একটি ছোট ইঞ্জিন – সেখানে অক্সিজেন পৌঁছালে সেই ইঞ্জিন চালু থাকে এবং শরীরকে চলমান রাখে। গাড়ির ইঞ্জিন যদি সম্পূর্ণ নিখুঁতভাবে জ্বালানি পুড়াতে পারত, তবে তার ধোঁয়া হতো শুধু কার্বন ডাই অক্সাইড আর পানি। আমাদের শরীরের ক্ষেত্রেও তাই – কোষের ইঞ্জিন অক্সিজেন পেয়ে যখন খাদ্য পুড়িয়ে শক্তি বানায়, তখন প্রধান বর্জ্য হিসেবে কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানি তৈরি হয়, যা আমরা নিঃশ্বাসে বাইরে ফেলি। ভাবুন তো, যদি গাড়ির ইঞ্জিনে ঠিকমতো বাতাস না পৌঁছায়, তবে ইঞ্জিন হোঁচট খেতে থাকে, গাড়ি শক্তিহীন হয়ে পড়ে। তেমনি আমরা যদি খুব হাঁফিয়ে সামান্য বাতাস পাই বা খুব অগভীর শ্বাস নেই, তবে কোষগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না – শরীর ক্লান্ত ও নিস্তেজ অনুভব করে। অন্যদিকে, গভীর ও পূর্ণ শ্বাস-প্রশ্বাস মানে শরীরের ইঞ্জিনগুলোতে প্রচুর অক্সিজেন পৌঁছানো, যা আমাদের শক্তি ও কর্মদক্ষতা বাড়ায়। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিটি কোষে শক্তি উৎপাদনের পেছনে শ্বাসের বড় অবদান আছে – অক্সিজেন ও গ্লুকোজ মিলেই কিন্তু সেই ব্যবহারযোগ্য শক্তি তৈরির প্রক্রিয়া চলে, তাই শ্বাস ঠিকমতো না হলে কোষীয় শক্তি উৎপাদন ধীর হয়ে যায়।
প্রাণশক্তি: শ্বাসের আধ্যাত্মিক দিক
শুধু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে নয়, শত শত বছর ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতি শ্বাসকে দেখেছে জীবনীশক্তির উৎস হিসেবে। আমাদের উপমহাদেশীয় দর্শন ও যোগবিদ্যায় শ্বাসকে বলা হয় প্রাণবায়ু বা প্রাণশক্তি – যার সরল অর্থ জীবনধারণের শক্তি বা জীবনের স্পন্দন। সংস্কৃত শব্দ “প্রাণ” মানে জীবন এবং “আয়াম” মানে নিয়ন্ত্রণ; প্রाणায়াম হল শ্বাসের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবনশক্তির নিয়ন্ত্রণ। ধারণা করা হয়, আমরা যে বায়ু গ্রহণ করি, তার মাধ্যমেই এই প্রাণশক্তি আমাদের দেহে প্রবেশ করে এবং সারা শরীরে প্রবাহিত হয়। আসলে প্রাচীন ঋষিরা বলতেন, নিতান্ত সাধারণ বায়ু নাকে প্রবেশ করে প্রাণশক্তির বাহনে পরিণত হয় – শরীরে সতেজতা ও নবজীবন আনে। তাই শ্বাসকে কেবল অক্সিজেনের বাহক না ভেবে জীবনীশক্তির বাহক হিসেবেও দেখতে পারেন। যখন আপনি গভীর শ্বাস নেন, কেবল ফুসফুস নয় – মনে অনুভব করুন সেই প্রাণশক্তি আপনার পুরো দেহে ছড়িয়ে পড়ছে, প্রতিটি কোষে নবজীবন দিচ্ছে। অনেকেই বলেন, জন্মের সময় শিশুর প্রথম যে চিৎকার করে শ্বাস নেয়, সেটিই তার জীবনে প্রথম স্ফুলিঙ্গ প্রজ্জ্বলিত করে – অর্থাৎ প্রথম শ্বাসেই তার প্রাণশক্তির প্রদীপ জ্বলে ওঠে। প্রতিটি শ্বাস যেন সেই জীবনপ্রদীপের স্ফুলিঙ্গকে জিইয়ে রাখে। ধীরে, গভীরভাবে নিশ্বাস গ্রহণ ও নিঃশ্বাসত্যাগ করার মধ্যে এক ধরনের ধ্যানজাত অনুভূতি আছে – এতে শরীর যেমন বেশি অক্সিজেন পায়, তেমনি মনে একটা প্রশান্তির অনুভূতি ছড়ায়, এবং বলা হয় এটি আমাদের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তিকে জাগ্রত ও সঞ্চালিত করে।
উপসংহার
শ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের জীবনের ভিত্তি, যার বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা দুই দিকই সমানভাবে আকর্ষণীয়। একদিকে, শ্বাস আমাদের কোষগুলিকে অক্সিজেন দিয়ে শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করছে, জীবনীশক্তি জোগাচ্ছে; অন্যদিকে, শ্বাসই আবার আমাদের প্রাণ বা জীবনশক্তির ধারক, যা সচেতনভাবে গ্রহণ করলে শরীর-মন উভয়ই উপকৃত হয়। পরবর্তীবার যখন আপনি শ্বাসের ব্যায়াম করবেন বা ধ্যান করবেন, এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে অনুভব করুন – প্রতিটি নিশ্বাসের সাথে যেন অক্সিজেনের পাশাপাশি প্রাণশক্তিও প্রবাহিত হয়ে আপনার প্রতিটি কোণায় পৌঁছে যাচ্ছে। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে আপনার দেহ অবাঞ্ছিত বর্জ্য ও নেতিবাচকতা বাইরে ফেলে দিচ্ছে। এইভাবে সচেতন শ্বাস আপনার ভেতরের প্রদীপকে উজ্জ্বল রাখছে, আপনার দেহ-মনকে শক্তি ও শান্তিতে পূর্ণ করছে। শ্বাসকে উপলব্ধি করে ধীরে ধীরে নিন এবং ছাড়ুন – দেখবেন, জীবনের এই সহজ তালেই অদ্ভুত শক্তি ও প্রশান্তির উৎস লুকিয়ে আছে।
সরলভাবে বললে, শ্বাসই জীবন। এটি আমাদের অন্তর্লীন শক্তির শিখাকে জ্বালিয়ে রাখে এবং প্রতি মুহূর্তে নবীকরণ করে। তাই শ্বাস নেওয়ার সময় মনে মনে বলুন: “আমি জীবন নিচ্ছি,” আর শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলুন “আমি মুক্ত করছি।” এই সচেতনতা আপনার শরীরের প্রতিটি কোষকে শক্তিতে ভরিয়ে তুলবে এবং আপনাকে ভেতর থেকে প্রাণবন্ত ও উদ্দীপিত রাখবে। শ্বাসের এই অলৌকিক প্রক্রিয়াকে শ্রদ্ধা জানানোর এটিই মোক্ষ – বিজ্ঞানের চোখে হোক বা আধ্যাত্মিক চোখে, শ্বাস সত্যিই আমাদের জীবনীশক্তির মূল উৎস।
©আরিফ আহমদ
No comments:
Post a Comment